লেখক: জ্যোতির্ময়,গবেষক, বায়রয়েৎ বিশ্ববিদ্যালয়
যোগাযোগ: https://twitter.com/GeophyJo পডকাস্ট: পল্লবী মালো, ভারতীয় বিজ্ঞান সংস্থা
সৌরজগতে পৃথিবী একমাত্র গ্রহ যেখানে প্লেট টেক্টোনিক্স হয় - অর্থাৎ পৃথিবীর উপরিভাগের খোলস বা লিথোস্ফিয়ার (ভূত্বক নয়) ক্রমশ পরিবর্তনশীল। প্রাণের বিবর্তন, বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক সামঞ্জস্য রাখা সমস্তই একান্ত ভাবে প্লেট টেক্টোনিক্স দিয়ে প্রভাবিত হয়। তাই, মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য যেমন পদার্থ বিজ্ঞানীদের কাছে রোমান্টিক বিষয়, বায়োলজিস্ট দের কাছে প্রাণের সৃষ্টি যেমন রহস্যোদ্দীপক, ভূবিজ্ঞানদের কাছে প্লেট টেক্টনিক্সের উৎস খুঁজে বের করা একই রকম রোমাঞ্চকর বিষয়। ৫০ বছেরের বিবর্তনে প্লেট টেক্টোনিক্স এর ধারণা ক্রমশ আরো উন্নত হয়েছে, বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে। কিন্তু প্লেট টেক্সটোনিক্স কি করে শুরু হলো, সেই নিয়ে খুব পরিষ্কার ধারণা এখনো পাওয়া যায় নি।
পৃথিবী বিজ্ঞানের একটা বিরাট অংশ অজানা। কিন্তু স্কুলে পড়ার সময় ভূগোলের কিছু অংশ বাদে পৃথিবী বিজ্ঞান নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয় না। দুর্ভাগ্যবশত, স্কুল লেভেলে সেই সব বইতে অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং তত্ত্ব ভুলে ভরা। এবং অনেকেরই একটা সহজাত প্রক্রিয়া দেখেছি, যে পৃথিবী বিজ্ঞানের প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিত ভাবে দিয়ে ফেলেন। উদাহরণ হিসাবে বেশ কিছু বাজার চলতি বিজ্ঞানের কথা ধরা যেতে পারে। বহু মানুষ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে দেন পৃথিবীর ভিতরে আছে গলিত লাভা, যার ওপর প্লেট গুলো ভেসে বেড়ায়। বা, কেউ বলে দিলো আস্থেনোস্ফিয়ার গলিত। কেউ আবার নিজের মতো করে আইসল্যান্ডের হটস্পট নিয়ে নিজস্ব মতবাদ দিয়ে দিলো, কেউ আবার বলে দিলো পৃথিবীর প্রথম মহাদেশের নাম পানজিয়া। স্কুলের পড়ুয়ারা অনেক ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ভ্রান্ত ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তুলনায় মহাকাশ বিজ্ঞানের প্রচার এবং প্রসার অনেক বেশি। সাধারণ মানুষও জানেন জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ, নিত্যনতুন তার ছবি দেখছে, কিন্তু আমাদের পৃথিবীর মধ্যে কি চলছে, সেই নিয়ে সম্যক ধারণা নেই। প্রথম সাবডাকসান জোন তৈরী হওয়ার সময় গণনায় রয়েছে বিস্তর গোলমাল। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের (Yale University) থিওরিটিক্যাল ভূপদার্থবিজ্ঞানী জুন করেনেগা (Jun Korenega) একটি রিভিউ পেপার 1 এর মধ্যে তালিকাভুক্ত করে দেখিয়েছেন বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা প্লেট টেক্টনিক্সের উৎস হিসাবে কোন সময়কালকে নির্দেশ করেছেন। তার তথ্য বলছে, আজ পর্যন্ত যা গবেষণা হয়েছে, তাতে ৪৪০ কোটি বছর থেকে ৬ কোটি বছরের মধ্যে যেকোনো সময়েই প্লেট টেক্টনিক্সের শুরু হতে পারে। বোঝাই যাচ্ছে, বয়েসের কোনো পিনপয়েন্ট করা সম্ভব হয়নি এখনো। বর্তমানে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের (Peking University) গবেষক মিং টাং (Ming Tang) তার ২০১৬ সালে Science পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণা পত্রে 2জানান আজ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগে আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত লাভার রাসায়নিক উপাদান পরিবর্তিত হয়। অধিক ম্যাগনেসিয়াম লোহা সমৃদ্ধ লাভা (Mafic) থেকে ক্রমশ ফেল্ডস্পার সিলিকা (Felsic) জাতীয় লাভার পরিমান বৃদ্ধি পায়। এটা প্লেট টেক্টোনিক্স শুরু হবার একটা বিশেষ লক্ষণ। যদিও কেন প্লেট টেক্টোনিক্স শুরু হলো, সেই বিষয়ে বিজ্ঞানী টাং এর কোনো বিশেষ বক্তব্য ছিল না। ২০১৫ সালে, Nature পত্রিকায় এতেহা জুরিখ (ETH Zurich) এর বিজ্ঞানী তারাস গেরিয়া (Taras Gerya) এবং তার গ্রুপের গবেষকরা গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে দেখান ম্যান্টল প্লিউমের (Mantle Plume) উদ্গিরণ হলে সাবডাকসান জোন তৈরী হতে পারে এবং সেখান থেকে প্লেট-টেক্টোনিক্স শুরু হতে পারে 3। ম্যান্টল প্লিউম হলো একধরণের বড়ো আগ্নেয়গিরি। পৃথিবীর অধিকাংশ অগ্নুৎপাত হয় খুব স্বল্প গভীরতা থেকে, ৫-৪০ কিলোমিটারের মধ্যে। কিন্তু ম্যান্টল প্লিউমে প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার গভীরতা থেকে ম্যাগমা উঠে আসে এবং বিশাল অগ্নুৎপাত ঘটায়। আমাদের দেশে দাক্ষিণাত্যের মালভুমি এই রকম একটা প্লিউম থেকে তৈরী হয়েছিল। যখন বিশাল আকারের আগ্নেয় গিরি তৈরী হয়, তখন পৃথিবীর উপরিভাগের শক্ত স্তর বা লিথোস্পিয়ারকে (ভূত্বক নয়) ফাটিয়ে দিতে পারে। বেশ ডিমের খোলা ফাটানোর মতো ব্যাপার। একবার এই রকম ফাটল তৈরী হলে, তবে প্লেটের সাবডাকশন সম্ভব হতে পারে।কি ভাবে ম্যান্টল প্লিউম থেকে সাবডাকসান জোন তৈরী হতে পারে, তার একটা কাল্পনিক ছবি নিচে এঁকে দেখালম। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালের (Durham University) বিজ্ঞানী যেহূন ভ্যান হুইনান (Jeroen van Hunen) ২০০৮ সালে মডেল করে দেখিয়েছিলেন যে সাবডাকসান জোন হটাৎ করে তৈরী হয় না, শুরুতে কিছু ছোট ছোট সাবডাকসান জোন ছিল, যাদের বলে প্রোটো সাবডাকসান জোন 4। এখানে প্রাথমিক সাবডাকশন শুরু হয়ে কিছু দিনের মধ্যেই নিমজ্জিত পাত ছিঁড়ে যায়, সাবডাকসান বন্ধ হয়ে যায়। আবার একই অঞ্চলে সাবডাকসান শুরু হয় এবং বন্ধ হয়। এই ভাবে পর্যায়ক্রমে সাবডাকসান চলতে থাকে, (Episodic subduction) যত দিন না পৃথিবী যথেষ্ট ঠান্ডা হয়ে যায়। পরবর্তী কালে পৃথিবীর উষ্ণতা আরো কমে গেলে দীর্ঘ মেয়াদি সাবডাকসান তৈরী হয়, যা প্লেট টেক্টনিক্সের উপযোগী হতে পারে। বর্তমানে এতেহা জুরিখে গবেষণারত তরুণী বিজ্ঞানী মার্টিন উলভরোভা (Martina Ulvrova) এবং বিজ্ঞানী পল টেকলি (Paul Tackley) মনে করেন সাবডাকসান জোন তৈরী হবার জন্য মহাদেশ তৈরী হবার দরকার আগে 5। মহাদেশ না তৈরী হলে উপযুক্ত সাবডাকসান জোন তৈরী হবে না। পৃথিবীর বিগত ২০ কোটি বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে অধিকাংশ সাবডাকসান জোন তৈরী হয়েছে মহাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। আজকের পৃথিবীতে সমস্ত সাবডাকসান রয়েছে আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়ার উপকূল বরাবর। ৫০ বছরে প্লেট টেক্টনিক্সের উৎপত্তি নিয়ে আরো বহু হাইপোথিসিস রয়েছে। সমস্ত নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মোটা মোটা বই লেখা হয়ে যাবে। বর্তমানে আমাদের কিছু গবেষণা দেখাচ্ছে প্লেট টেকটোনিক্স শুরু হবার জন্য দরকার ছিল কিন্তু নির্দিষ্ট মাপের পাথরের দানা। ভবিষতের বিজ্ঞানীরা হয়তো খুঁজে বের করবে ভূবিজ্ঞানের সব থেকে প্রাচীন সমস্যার সমাধান। References: 1. Korenaga, J., 2013. Initiation and evolution of plate tectonics on Earth: theories and observations. Annual review of earth and planetary sciences, 41(1), pp.117-151. 2. Tang, M., Chen, K. and Rudnick, R.L., 2016. Archean upper crust transition from mafic to felsic marks the onset of plate tectonics. Science, 351(6271), pp.372-375. 3. Gerya, T.V., Stern, R.J., Baes, M., Sobolev, S.V. and Whattam, S.A., 2015. Plate tectonics on the Earth triggered by plume-induced subduction initiation. Nature, 527(7577), pp.221-225. 4. van Hunen, J. and van den Berg, A.P., 2008. Plate tectonics on the early Earth: limitations imposed by strength and buoyancy of subducted lithosphere. Lithos, 103(1-2), pp.217-235. 5. Ulvrova, M.M., Coltice, N., Williams, S. and Tackley, P.J., 2019. Where does subduction initiate and cease? A global scale perspective. Earth and Planetary Science Letters, 528, p.115836.
0 Comments
Leave a Reply. |
Archives
February 2023
Categories |