জ্যোতির্ময়,গবেষক, বায়রয়েৎ বিশ্ববিদ্যালয়
যোগাযোগ: https://twitter.com/GeophyJo পডকাস্ট: পল্লবী মালো, ভারতীয় বিজ্ঞান সংস্থা কিছু কিছু বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন আছে, যাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের অফুরন্ত কৌতূহল। যেমন, মহাবিশ্বের সৃষ্টি, প্রাণের সৃষ্টি ইত্যাদি সংক্রান্ত প্রশ্ন বিশেষ জনপ্রিয়। আর কিছু প্রশ্ন আছে, যেগুলো সাধারণ মানুষের কাছে এখনো বিশেষ জনপ্রিয় নয়, কিন্তু বিজ্ঞানীদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। কিছুটা সদুত্তর পাওয়া গেলেও, সম্পূর্ণ ধোঁয়াশা কাটে নি। এরকম একটা বিদঘুটে প্রশ্ন হলো মহাদেশের সৃষ্টি এবং তার বিবর্তন। মহাদেশ ও প্রাণের উৎস দীর্ঘ কাল ধরে একটা ধারণা আমাদের আছে যে প্রাণের উৎস হয়েছিল জলে। জলের মধ্যেই তৈরী হয়েছিল প্রিমোর্ডিয়াল স্যুপ, যেখান থেকে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরী হয় প্রাণের প্রথম পদক্ষেপ। আধুনিক বিজ্ঞানীরা মনে করেন শুধু জল থাকলেই প্রাণ তৈরী নাও হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অগভীর জল হতে হবে। মহাসমুদ্রের মাঝে প্রাণ তৈরী হওয়া সহজ নয়। সেক্ষেত্রে, যদি মহাদেশ তৈরী হয় এবং মহাদেশ-মহাসাগরের ঢাল (continental shelf) বরাবর যে অগভীর সমুদ্র তৈরী হয়, সেটাই প্রাণ তৈরির আদর্শ জায়গা হতে পারে। অর্থাৎ, মহাদেশ বা স্থলভাগ প্রাণের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।
আমরা (মানুষরা) মহাদেশের ওপর বসবাস করি। জলের ওপর আমরা থাকতে পারবো না। পৃথিবীর জীবজগতের একটা বিরাট অংশ স্থলভাগের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং আমাদের খাদ্য (অধিকাংশ), বস্ত্র, এবং বাসস্থান - সবই আসে মহাদেশ থেকে। মহাদেশের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে তৈরী হয় আমাদের খাদ্যাভ্যাস, এবং জীবনযাত্রার প্রণালী। ইতিহাসের পথে একটু পিছনে হাঁটলে দেখা যায় এই মহাদেশগুলো ক্রমশ স্থান পরিবর্তন করেছে। কখনো বিরাট আকার ধারণ করেছে, যাদের বলে সুপারকন্টিনেন্ট, আবার কখনো ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে চলে গেছে। এই মুহূর্তে পৃথিবীর মানচিত্র দেখলে দেখতে পাবো সাতটা মহাদেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আজ থেকে ২০ কোটি বছর আগে সমস্ত মহাদেশ এক সাথে জুড়ে ছিল। আজ থেকে প্রায় ৬০ কোটি বছর আগে আবার সবাই আলাদা আলাদা ছিল, তারও আগে বারবার জুড়েছে আবার ভেঙেছে। এই ভাঙা গড়ার খেলা চিরন্তন। ১৯৬০-৭০ এর দশকে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন প্রায় ৫০ কোটি বছর অন্তর অন্তর মহাদেশের ভাঙা গড়ার খেলা চলে। বিজ্ঞানী টুজো উইলসনের নামে এই চক্রের নাম দেওয়া হয় "Wilson Cycle", যদিও, আধুনিক গবেষণাতে দেখা গেছে সুপারকন্টিনেন্টের ভাঙা গড়া ঠিক ৫০ কোটি বছরই হয় না, বরং এই সময়কাল বেশ অনিয়ন্ত্রিত [২]। মহাদেশের ইতিহাস প্যাঞ্জিয়া কি করে কি ভাবে সমস্ত মহাদেশগুলো স্থান পরিবর্তন করেছে - তার হিসাব বেশ জটিল এবং এই মুহূর্তে ভূবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়। মহাদেশের ইতিহাস বর্তমান থেকে শুরু করা যেতে পারে। ধরা যেতে পারে এখন পৃথিবীতে সাতটি মহাদেশ, তবে সেটা রাজনৈতিক ভাবে। প্রাকৃতিক ভাবে ইউরোপ এবং এশিয়া একটাই মহাদেশ। বাকিরা বিচ্ছিন্ন। মহাদেশের ইতিহাসের সাথে সাথে পিছিয়ে যেতে থাকলে দেখা যাবে সময়ের সাথে মহাদেশ কখনো এক সাথে জুড়ে গিয়ে সুপারকন্টিনেন্ট তৈরী করেছে। বারবার ভাঙ্গাগড়ার খেলায় সব থেকে নতুন বা সর্বশেষ সুপারকন্টিনেন্ট প্যাঞ্জিয়া।
বর্তমান থেকে ৬০ কোটি বছর আগে পর্যন্ত পৃথিবীর মহাদেশের অবস্থান।
রোডিনিয়া ১৯৭০ দশকে, বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন প্যাঞ্জিয়ার আগেও আরো কিছু সুপারকন্টিনেন্ট থাকা সম্ভব। এই অনুমান ক্রমশ নিশ্চিত হয় যখন এখনকার পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের মধ্যে ১০০-১৩০ কোটি বছর পুরোনো কিছু পর্বতমালা পাওয়া যায়। অর্থাৎ, ১০০-কোটি বছর আগে এরা সম্ভবত সবাই সংযুক্ত ছিল, এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা এই সুপারকন্টিনেন্টের নাম দিলেন রোডিনিয়া, রাশিয়ান ভাষায় যার অর্থ মাতৃভূমি। Rodinia কেমন দেখতে ছিল, সেই নিয়ে বহু বিতর্ক আছে [৩]। প্যাঞ্জিয়ার ম্যাপ এখন যেমন অনেকটা নির্ভুল ভাবে পাওয়া যায়, রোডিনিয়ার ম্যাপ বিতর্কিত। মোটামুটি ভাবে বলতে গেলে এই সুপারকন্টিনেন্টের কেন্দ্র ছিল ল্যারেন্সিয়া, যা আজকের দিনে অধিকাংশই উত্তর আমেরিকা মহাদেশের অন্তর্গত। পূর্ব প্রান্তে ছিল বাল্টিকা আর আমাজোনিয়া। বাল্টিকা হলো আজকের দিনের নরওয়ে, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের বিস্তৃত অঞ্চল, আর আমাজোনিয়া হলো ব্রাজিলের উচ্চ ভূমি। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আন্টার্কটিকা আর আফ্রিকা ছিল এই মহাদেশের পশ্চিম প্রান্ত বরাবর। প্যাঞ্জিয়ার থেকে এই সুপারকন্টিনেন্টের অক্ষাংশ গত বিস্তর ফারাক। প্যাঞ্জিয়ার অনেকটা স্থুল অংশ যেমন মেরু অঞ্চলের দিকে ছিল এবং ক্রান্তীয় অঞ্চল ছিল শীর্ণ, রোডিনিয়া ছিল প্রধানত একটি ক্রান্তীয় মহাদেশ। এতো বিস্তীর্ন ক্রান্তীয় অঞ্চল জুড়ে এতো বড় মহাদেশ পৃথিবীর ইতিহাসে আগে তৈরী হয় নি [৪]। ক্রান্তীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাত বেশি হয়, ফলে মহাদেশীয় পাথর ভীষণ দ্রুত ক্ষয় হয় - যাকে বলা হয় আবহবিকার। মহাদেশের এই সমস্ত ফেলসিক পাথর গুলো ক্ষয় হলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে শোষণ করতে পারে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমে যাওয়া মানে প্রধান গ্রীন হাউস গ্যাস কমে যাওয়া - অর্থাৎ পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমশ হ্রাস পাবে। দীর্ঘদিন ক্রান্তিয় অঞ্চলের পাথরের আবহবিকারের ফলে সম্ভবত পৃথিবীর গড় উষ্ণতা কমতে থাকে। প্রায় ৭২ কোটি বছর আগে পৃথিবী ক্রমশ বরফে ঢেকে যেতে থাকে। সমগ্র পৃথিবী একটা বরফের বলে পরিণত হয়, যাকে বলা হয় snowball Earth, প্রায় ১০ কোটি বছর পৃথিবীর এই বরফ দশা চলতে থাকে। আজ থেকে প্রায় ৬৩ কোটি বছর আগে আবার পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
রোডিনিয়ার পুনরসজ্জা
কলম্বিয়া
কলম্বিয়ার পুনরসজ্জা
সুপেরিয়ার পুনরসজ্জা
References:
১. ভূগোলে গোল পর্ব ১: SiAl SiMa (https://geoedu.weebly.com/bengali-blog/geography-conceptual-mistake-sial-sima) ২. Torsvik, T.H. and Cocks, L.R.M., 2016. Earth history and palaeogeography. Cambridge University Press. ৩. Torsvik, T.H., 2003. The Rodinia jigsaw puzzle. Science, 300(5624), pp.1379-1381. https://doi.org/10.1126/science.1083469 ৪. Mitchell, R.N., Zhang, N., Salminen, J., Liu, Y., Spencer, C.J., Steinberger, B., Murphy, J.B. and Li, Z.X., 2021. The supercontinent cycle. Nature Reviews Earth & Environment, 2(5), pp.358-374. https://doi.org/10.1038/s43017-021-00160-0 ৫. Merdith, A.S., Williams, S.E., Collins, A.S., Tetley, M.G., Mulder, J.A., Blades, M.L., Young, A., Armistead, S.E., Cannon, J., Zahirovic, S. and Müller, R.D., 2021. Extending full-plate tectonic models into deep time: Linking the Neoproterozoic and the Phanerozoic. Earth-Science Reviews, 214, p.103477. https://doi.org/10.1016/j.earscirev.2020.103477
0 Comments
Leave a Reply. |
Archives
February 2023
Categories |