ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে বহু ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্য সহজেই দেখা গেলেও হিমবাহ সাধারণত আমাদের নাগালের বাইরে। হিমালয় অঞ্চলে অসংখ্য হিমবাহ থাকলেও তাদের উচ্চতা অনেক বেশি হওয়ার কারণে সেসব জায়গায় পৌঁছানো বেশ দুষ্কর হয়ে ওঠে। আল্পসের উচ্চতা কম, এবং উচ্চ অক্ষাংশে থাকার কারণে হিমবাহ চলে আসে হাতের নাগালেই।
কয়েকদিন আগে আল্পসের কিছু অঞ্চলে ঘোরাফেরা করতে একদম গিয়ে পড়েছিলাম হিমবাহের মধ্যে। সেখান থেকে হিমবাহের ভূমিরূপের কিছু বৈচিত্র্য চোখের সামনে উঠে এলো। প্রথমে, একটা হিমবাহের উপত্যকা ঠিক কতটা গভীর হয়, সেটা আগে কখনো প্রত্যক্ষ করি নি। এই ছবি তে দেখা যাচ্ছে, দুজন মানুষ কে। আমার বন্ধু একটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, আর আমি অনেকটা নিচে, - ওই উঁচু জায়গায় ওঠার চেষ্টা করছি। আমার পায়ের নিচে প্রায় ২-৩ ফুট বরফ। এই পুরো জায়গাটাই হিমবাহের উপত্যকা। একদম নিচ থেকে শুরু করে ঢিবির উঁচু জায়গাটা পর্যন্ত প্রায় ১২-১৫ ফুট। যে ঢিবির মতো উঁচু জায়গাটা দেখা যাচ্ছে, সেটা হলো মরেন (Moraine)। উঁচু পাহাড় থেকে অজস্র বরফের ধারা বয়ে যায়, আর মাঝে মাঝে জমতে থাকে ওপরের পাহাড় থেকে বয়ে আনা শিলাচূর্ণ। এই হিমবাহ দৈর্ঘ্যে বেশ ছোট ছিল, তাই বিশেষ ক্ষয় করতে পারে নি। সেই কারণে শিলাচূর্ণের আকৃতি বেশ বড় বড়। হিমবাহের এই রকম সঞ্চয়কে (Glacial deposit) বলে টিল (Till)। টিল জমেই তৈরী হয় মরেন। টিলের মধ্যে থাকা বড় বড় শিলাচূর্ণকে বলে বোল্ডার (যে সব শিলার ব্যাস ২৫ সেন্টিমিটারের বেশি), যা একটা হিমবাহের সঞ্চয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কালের প্রবাহে হিমবাহ গলে যায়। কিন্তু হিমবাহের সঞ্চয়ের ফলে তৈরী বোল্ডার গুলো থেকে যায়। কোটি কোটি বছরের বিবর্তনে এরা আবার পাথরে পরিণত হয়। বোল্ডার থেকে তৈরী হওয়া পাথরকে বলে বোল্ডার বেড (Boulder bed)। এখন যদি ওড়িশার কোনো অঞ্চলে এই রকম বোল্ডার বেড পাওয়া যায়, তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায় আজকের ওড়িশায় বহু বছর আগে হিমবাহ ছিল। কিন্তু ক্রান্তীয় অঞ্চলের প্রায়-সমতল ভূমিতে হিমবাহ থাকা অসম্ভব ব্যাপার। ভূবিজ্ঞানীরা যখন ওড়িশার তালচের অঞ্চলে এই রকম বোল্ডার বেড আবিষ্কার করলো, তখন তারা প্রায় নিশ্চিত হতে পারলো যে, ভারতের ভুখন্ড এক সময় উচ্চ অক্ষাংশে অবস্থান করতো। কয়েক কোটি বছরের বিবর্তনে উচ্চ অক্ষাংশ থেকে ক্রান্তীয় অঞ্চলে সঞ্চরণ করেছে ভারতের ভূখণ্ড। সেদিনের হিমবাহ গলে গেছে, কিন্তু অস্তিত্ব রয়ে গেছে এই বোল্ডার বেডের। বিংশ শতকের শুরুর দিকে যখন মহাদেশীয় সঞ্চরণ তত্ত্ব নতুন রূপ পাচ্ছে, ক্রান্তীয় অঞ্চলের বোল্ডার বেডকেই অন্যতম প্রমান হিসাবে পেশ করেছিল ভূবিজ্ঞানীরা।
0 Comments
Leave a Reply. |
Archives
January 2024
Categories
All
|