দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ডুবোজাহাজ সনাক্ত করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেলো পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের দিক পরিবর্তন। কি করে হয়েছিল এই আবিষ্কার? ডুবোজাহাজের ভূমিকা প্রথম মহাযুদ্ধের সময় বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছিলো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে যুদ্ধরত দেশ গুলোর একটা উদ্দেশ্য ছিল ডুবোজাহাজের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া। এটা তখন সম্ভব হতে পারে, যদি জলের নিচে ডুবোজাহাজের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় আগে থেকে। সেই সময় স্যাটেলাইট এর প্রযুক্তি আজকের মতো ছিল না, তাই সমুদ্রের নিচের ছবি ছিল অজানা। ডুবোজাহাজের প্রযুক্তি তখন ভয়ঙ্কর উন্নত। জলের নিচে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত ডুবে থাকতে পারে এবং যুদ্ধের পটভূমিকায় এই রকম অতর্কিত আক্রমণ বিপর্যয় আনতে পারে। এবং অনেক ক্ষেত্রে বিপর্যয় যথারীতি ঘটেছে। মার্কিন নেভি (US Navy) ডুবোজাহাজকে জলের নিচে সনাক্ত করার জন্য তৎপর হয় ১৯৩০ এর শেষ দিকে। এতদিনে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র নিয়ে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে। নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে এগোলে চৌম্বক ক্ষেত্র শক্তিশালী হয়ে হয়ে ওঠে এবং তার পরিমাপ করা হয়েছে উনিশ শতকেই। ১৮৩৩ সাল নাগাদ গাউস বানিয়ে ফেলেছিলেন প্রথম ম্যাগনেটোমিটার, যার সাহায্যে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি পরিমাপ করা যায়। মার্কিন নেভির গবেষণা সংস্থা এই পরিমাপকে আরো উন্নত করতে চাইলো। যাতে কোনো ধাতব পদার্থ থাকলে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র কি ভাবে বিচ্যুতি ঘটবে, সেই সূক্ষ্ম যন্ত্র বানাবার দিকে বিশেষ নজর দিলো। এই যন্ত্র তৈরী হলে জলের নিচে ডুবোজাহাজের অস্তিত্ব বোঝা যাবে। ভিক্টর ভ্যাকুইর (Victor Vacquier), জন্মগত ভাবে একজন রাশিয়ান, ১৯২০ সালে আমেরিকা চলে আসেন। পদার্থবিদ্যা এবং ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনো শেষ করেন ১৯৩০ এর শুরুর দিকে। পড়াশুনো শেষ করে তিনি গালফ অয়েল (Gulf oil) কোম্পানির সাথে কিছুদিন গবেষণা করেন। এই কোম্পানিতে ভিক্টর কাজ করছিলেন একটি নতুন যন্ত্র নিয়ে, যার নাম ফ্লাক্সগেট ম্যাগনেটোমিটার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুতে ভিক্টর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এবং ফ্লাক্সগেট ম্যাগনেটোমিটারকে কিভাবে বিমানপোতে (airborne) ব্যবহার করা যায় সেই নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৪২ সাল থেকে এই যন্ত্রকে যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহার করা শুরু হয়। যুদ্ধ আপেক্ষিক ভাবে শেষ হলেও কৌতূহল শেষ হয় না। মহাসমুদ্রের তলদেশ নিয়ে তখন মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না। মার্কিন নেভি তাই সমস্ত সমুদ্রের ম্যাপ তৈরী করার একটি প্রজেক্ট শুরু হয়। Woods Hole Oceanographic Institute (MIT), Scripps Institution of Oceanography (University of California, San Diego), এবং Lamont Geological Observatory (Columbia University) - এই তিনটে প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয় প্রজেক্টে। যুদ্ধের সময় তৈরী অতিরিক্ত ফ্লাক্সগেট ম্যাগনেটোমিটার দিয়ে মহাসাগরের ম্যাপিং হয় ১৯৫০-১৯৬০ পর্যন্ত। আইসল্যান্ডের দক্ষিণ পশ্চিমে রেইকিয়ানিস শৈলশিরার (Reykjanes Ridge) কাছে সমুদ্রের পাথরের যে চৌম্বকত্ব পাওয়া গেলো, তা রীতিমত অবাক করে দিলো বিজ্ঞানীদের (চিত্র ১)। সমুদ্রের গভীরে নিমজ্জিত এই পাহাড়ের (শৈলশিরা) দুইপাশে সমান্তরাল ভাবে ক্রমাগত দিক পরিবর্তন করেছে চৌম্বক মেরু। অর্থাৎ বেশ কিছু কিলোমিটার জুড়ে পাথরের মধ্যে যে মিনারেল গুলো আছে, তারা বর্তমান উত্তর মেরুকে উত্তর মেরু হিসাবে দেখাচ্ছে (স্বাভাবিক মেরু), আবার তার পাশের বেশ কিছু কিলোমিটার জুড়ে পাথরের মধ্যে মিনারেল গুলো বর্তমান উত্তর মেরুকে তাদের দক্ষিণ মেরু হিসাবে দেখাচ্ছে (বিপরীত মেরু)। তার কিছু দূর গিয়ে আবার উল্টে যাচ্ছে মেরু। ক্রমাগত এই উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু বদলে যাচ্ছে পাথরের। আরো দেখা গেলো, সমুদ্রের মাঝে যে পাহাড় রয়েছে, তার দুইপাশে এই চৌম্বক মেরুর পরিবর্তন প্রতিসম। পাহাড়ের ডান দিকে পাঁচ কিলোমিটার পাথর যদি স্বাভাবিক মেরু দেখায়, বাম দিকেও পাঁচকিলোমিটার স্বাভাবিক মেরু দেখাবে। আবার ডানদিকে যদি ৫-১০ কিলোমিটার দূরত্বে বিপরীত মেরু থাকে, বামদিকেও একই জিনিস দেখা যাবে। অতলান্তিক ছাড়া, প্রশান্ত মহাসাগরে কানাডার পশ্চিমেও পাওয়া গেলো একই চিত্র। সমুদ্র পৃষ্ঠে চৌম্বক ক্ষেত্রে এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনকে বলা হয় Marine magnetic anomaly। এই ছবি বিশ্লেষণ করে প্রথম বোঝা গেলো পৃথিবীর চৌম্বক মেরু পরিবর্তন হয়েছে। তার প্রমান লুকিয়ে আছে সমুদ্র গর্ভে (চিত্র ২)। সাথে ভূবিজ্ঞানের চিন্তাভাবনার এক বিরাট পরিবর্তন হলো। আলফ্রেড ভাগনার মহাদেশীয় সরণের সপক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, মহাদেশ গুলো সমুদ্রের ওপর ভেসে বেরিয়েছে। কিন্তু কি কারণে মহাদেশ গুলো সমুদ্রের ওপর ভেসে বেড়াবে তার কোনো কারণ তখন জানা ছিল না। সমুদ্র পৃষ্ঠে চৌম্বক ক্ষেত্রে পরিবর্তন হতে দেখে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন মহাদেশ সরে যায় না, সমুদ্র পৃষ্ঠের মাঝ বরাবর যে পাহাড় বা শৈলশিরাগুলো আছে, সেখান থেকে পৃথিবীর ভিতরের ম্যাগমা উঠে আসে এবং সমুদ্র পৃষ্ঠ সম্প্রসারিত হয়। একসময় দুটো মহাদেশ এক সাথে যুক্ত ছিল, কিন্তু তাদের মাঝে সমুদ্র পৃষ্ঠ সম্প্রসারিত হওয়ার কারণে তারা দূরে সরে যায়। ম্যাগমার মধ্যে যে চৌম্বকীয় পদার্থ থাকে, তারা পৃথিবীর তৎকালীন চৌম্বক ক্ষেত্রের মেরুকে নিজেদের মধ্যে সংরক্ষিত করে রাখে। সমুদ্র পৃষ্ঠের সম্প্রসারণের এই ঘটনাকে বলে Sea Floor Spreading। ১৯৬০-৭০ এর সময় এই sea floor spreading হাইপোথিসিস এর ওপর ভিত্তি করেই তৈরী হয় আধুনিক plate tectonics theory, বা পাত সঞ্চরণ তত্ত্ব। Further readings:
Victor Vacquier Sr. dies at 101; geophysicist was a master of magnetics Vine, F.J., 1966. Spreading of the Ocean Floor: New Evidence: Magnetic anomalies may record histories of the ocean basins and Earth's magnetic field for 2× 108 years. Science, 154(3755), pp.1405-1415.
1 Comment
Dilip das
2/11/2024 01:33:40 pm
দারুণ লিখেছেন। এই ঘটনার কথা জানতাম না।
Reply
Leave a Reply. |
Archives
January 2024
Categories
All
|