বিগত কয়েক বছর, বা দশক ও বলা যেতে পারে, ধরেই আমরা গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে নানা রকম খবর শুনছি। খবর না বলে বিজ্ঞানী মহলের আলোচনা বা বিতর্কের ঝড় বলাই শ্রেয় হবে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং একটি ইংরেজি শব্দ যেটা শুনলে হয়তো আমরা সাধারণ মানুষরা অনেক সময়ই ঠিক আন্দাজ করতে পারি না আসলে বিজ্ঞানীরা কি কি সমস্যার কথা বোঝাতে বা বলতে চাইছেন। প্রধানত গ্লোবাল ওয়ার্মিং বলতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকেই ইঙ্গিত করা হয়। যদিও বাস্তবে ব্যাপারটা অনেকটা জটিল, কারণ পৃথিবী একটা খুবই জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চালিত হয়, শুধু জটিলই না বরং বুদ্ধিমান বললেও কিছু বেশি বলা হয়না। খুব গোদা বাংলায় ভাবলে আমরা পৃথিবীকে চারটি প্রধান স্তরে ভাগ করতে পারি, (১) শিলামণ্ডল (২) বারিমণ্ডল (৩) বায়ুমণ্ডল এবং (৪) জীবমণ্ডল। মজার ব্যাপার হল এই চারটি মণ্ডল একটি অন্যটির সাথে খুবই নিবিড় ভাবে জড়িত। একটা উদাহরণ দিলে হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে একটু সুবিধা হবে, এই যে আমরা বৃষ্টিপাত হতে দেখি সেক্ষেত্রে কি ঘটে, বায়ুমণ্ডল থেকে জল-বিন্দু ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়, তা বায়ুমণ্ডলে জল-বিন্দু এল কোথা থেকে, নাম শুনেই তো মনে হওয়া উচিত যে বায়ুমণ্ডলে থাকবে বায়ু, মানে বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থের মিশ্রণ। তো এই বায়ুমণ্ডলে জল আসে বারিমণ্ডল থেকে, বিভিন্ন জলাশয় থেকে জল সূর্যের তাপে বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমণ্ডলে আসে, আর তা থেকেই বৃষ্টি হয়। সাধারণ ভাবে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বাষ্পীভবনের ও হার বেড়ে যায়, যদিও বাস্তবে তাপমাত্রা আর বাষ্পীভবনের সম্পর্কটা এতটা সহজ সরল না, কিন্তু সহজ ভাবে ভাবতে হলে ঘটনা তা অনেকটা এমন দাঁড়ায় যে বেশি তাপমাত্রায় বেশি জলীয় বাষ্পের সৃষ্টি হয় এবং তাতে বৃষ্টিপাত এর পরিমান বাড়ে। আর আমরা তো সকলেই জানি যে জল (বৃষ্টি) ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব না। বৃষ্টিপাত, সমুদ্রের জলের লবণাক্ততা, অম্লতা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে জীবমণ্ডলের বিবর্তন হয়। আবার এই জীবমণ্ডল পৃথিবীর শিলমন্ডলের ওপর নিজের জীবনযাপন করে, খাদ্য সংগ্রহ করে। এই বিশাল প্রাকৃতিক ভারসাম্য যদি কোনো ভাবে বিঘ্নিত হয়, তা সমস্ত প্রাণীকুলের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকারক হবে। তাই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে তা কেবল মাত্র সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, মানুষের জীবনকেও প্রভাবিত করবে। স্বাভাবিক ভাবেই পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে গেলে মেরু প্রদেশের বরফ গোলে যাবে, তাতে সমুদ্র-পৃষ্ঠের জলস্তর বাড়বে, ফলে উপকূলীয় অঞ্চল জলের তলায় চলে যাবে ধীরে ধীরে। খুবই মজার ব্যাপার যে, যদি আমরা এটা একটু খেয়াল করে দেখি, দেখবো পৃথিবীর সব বড় বড় শহরই সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে অবস্থিত, তো স্বাভাবিক ভাবেই সব গুরুত্বপূর্ণ শহর জলমগ্ন হবে, আমাদের কলকাতা বা ঢাকাও কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠের খুব কাছেই অবস্থিত, প্রায় ৫-১০ মিটার এর মতো হবে এই শহর গুলির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে। তাই আমাদের একটু সচেতন হয়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং কেন হয় আর তা থামানোর জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এ যে শুধু পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে, বরফ গোলে সমুদ্র-পৃষ্ঠের জলস্তর বেড়ে যাবে তা নয়। বৃষ্টিপাতের পরিমান বেড়ে বা কমে যাবে এবং তা অনেক অনিয়মিত ভাবে ঘটতে থাকবে, অতিবৃষ্টির জন্য বন্যা বা অনাবৃষ্টির জন্য খরা দেখা যাবে। এই তো কয়েক বছর আগেই ভারতের চেন্নাই শহরে বা মহারাষ্ট্র লাতুর অঞ্চল বা ব্যাঙ্গালোরে মতো শহরে জল সংকট অতি প্রকট হচ্ছে। যদিও জল সংকট এর জন্য অনাবৃষ্টি এক মাত্র কারণ না, যাই হোক সে বিষয়ে আমরা যাচ্ছি না। এছাড়াও বাড়বে ঘূর্ণি ঝড়ের প্রকোপ, কারণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা সমুদ্রের উপরিতলের তাপমাত্রাও বাড়িয়ে দেবে, আর তাতেই ঘূর্ণি ঝড় সৃষ্টির পরিমান বাড়বে আর তা হবেও অনিয়মিত ভাবে। আর সব থেকে বড় ব্যাপার অনেক প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্বের অবসান ঘটবে বা সংকট দেখা যাবে, কারণ মানুষ এই কমবর্ধমান তাপমাত্রার কয়েক ডিগ্রী ব্যবধানকে সহ্য করে নিতে পারলেও এই বিশাল প্রাণীকুলের অনেক জীব-ই তা পারবে না।। আমরা মানুষরা (বেশির ভাগ) হয়তো এই ভাবে ক্রমাগত তাপমাত্রার বৃদ্ধির ফলে সরাসরি মারা যাবো না, কিন্তু যদি অন্যান্য প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে তাতে প্রাকৃতিক খাদ্য শৃঙ্খল-এ বিঘ্ন ঘটবে এবং শেষে মানুষও সেই বিপদে পড়বে। তাই আমাদের নিজেদের স্বার্থেই সচেতন হওয়া দরকার। এবার আসা যাক যে এই গ্লোবাল ওয়ার্মিং হয় কি কারনে? এর পিছনে অনেক কারণ আছে যেমন পৃথিবীর অক্ষের উপর পৃথিবীর অবস্থান কোথায় হচ্ছে বা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমানও খুবই গুরুত্বওপূর্ণ। যেমন পৃথিবীর অবস্থান এর উপর নির্ভর করে সূর্য থেকে আগত শক্তির পরিবর্তন হয়, তাতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তেমনি বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত মিথেন, কার্বন-ডাই -অক্সাইড, নাইট্রাস-অক্সাইড ইত্যাদি, হল গ্রীন হাউস গ্যাস, আর এই গ্যাস গুলি সূর্য থেকে আগত শর্টওয়েভ বিকিরণ কে সহজেই পৃথিবী পৃষ্ঠের দিকে আস্তে দেয় কিন্তু ভূপৃষ্ঠে প্রতিফলন এর পর লংওয়েভ বিকিরণকে কে মহাশুন্যে ফিরে যেতে দেয়না, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আটকে রাখে আর তাতেই যত বিপত্তি। ক্রমাগত এইভাবে সূর্য থেকে আগত শক্তি বায়ুমণ্ডলে আটকে থাকলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়তে থাকে এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর সৃষ্টি হয়। এখানে প্রধান প্রশ্ন হবে যে তাতে মানুষের দোষটা কোথায় কারণ ইহা তো একটি ন্যাচারাল প্রসেস। হুম, গ্রীন হাউস গ্যাস গুলোর এটাই স্বাভাবিক প্রকৃতি আর তাতে মানুষের কোনো ভূমিকা নেই। তবে মানুষের ভূমিকা আছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এই গ্যাস গুলোর ক্রমাগত পরিমান বৃদ্ধির জন্য। যথেচ্ছ এবং অপরিকল্পিত ভাবে জীবাস্ম জ্বালানির (কয়লা, খনিজ তেল) ব্যবহারের ফলে ক্রমাগত ভাবে বাতাসে মিথেন, কার্বন-ডাই -অক্সাইড, নাইট্রাস-অক্সাইড ইত্যাদি গ্যাস গুলির পরিমান বাড়ছে। মজার ব্যাপার যে জলীয় বাস্প ও একটি গ্রীন হাউস গ্যাস, আর কৃষিকাজ এর জন্য (ধান চাষ উল্লেখ যোগ্য) যে জলসেচ দেওয়া হয় তার ফলে আমরা কৃত্তিম ভাবে জলীয় বাষ্পের পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছি। তবে শুধুমাত্র মানুষই যে এই গ্যাস গুলির সৃষ্টি করছে এমন না, এই গ্যাস গুলো চিরাচরিত কাল থেকেই প্রাকৃতিক ভাবেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ছিল, মানুষ শুধুমাত্র এই গ্যাস গুলোর পরিমান বৃদ্ধি করেছে বা পরিমান বৃদ্ধির গতি (রেট) বাড়িয়ে দিয়েছে, আর সেটাই প্রধান চিন্তার কারণ। মূলত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাত এর সময় এই সব নানান গ্রীন হাউস ভূপৃষ্ঠের গভীর থেকে বায়ুমণ্ডলে আসে স্বাভাবিক ভাবেই। আগেই বলেছি যে পৃথিবী একটি জটিল এবং বুদ্ধিমান প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে চলে তাই খুব সহজেই পৃথিবী নিজেই এই গ্যাস গুলোর বায়ুমণ্ডলে পরিমান সঠিক ভাবে বজায় রাখে বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু সেগুলি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, সাধারণত এই ধরণের প্রক্রিয়া গুলো জিওলজিকাল টাইম ফ্রেমে (অতি লম্বা সময় মানুষের আয়ুর দৈর্ঘ্যের সাপেক্ষে) ঘটে। আমরা আগামী পর্বে তেমনি একটু বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।
1 Comment
Abhijit Bhattacharya
8/9/2021 03:55:28 pm
Khub bhalo lekha. Aaro erom informative lekha chai.
Reply
Leave a Reply. |
Archives
January 2024
Categories
All
|