উনিবংশ শতাব্দী বিজ্ঞানের বহু যুগান্তকারী আবিষ্কারের সাক্ষী। পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন ছাড়াও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এসেছিলো "বিবর্তন"। শতাব্দীর মাঝা মাঝি সময়ে আসে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব। এই তত্ত্বের মূল ভিত্তি ছিল অভিন্নতাবাদ, যা মনে করে পৃথিবীর বয়েসের কোনো আদি অন্ত নেই। ডারউইন এই অসীম সময়ের প্রথম ভূতাত্ত্বিক হিসাব করে দেখান যে ব্রিটিশ উপকূলের যে ভূমিরূপ তৈরী হয়েছে তা হতে সময় লেগেছে অন্তত ৩০০ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি বছর। পদার্থবিজ্ঞানীরা সময়ের এই অসীমত্বকে মানতে নারাজ। সেই সময়ের বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন গাণিতিক হিসাব কষে দেখান যে পৃথিবীর গড় বয়স মাত্র ৯৮ মিলিয়ন বছর বা ৯.৮ কোটি বছর। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব পড়লো প্রবল বিরোধিতার মুখে। পদার্থ বিজ্ঞানীদের অঙ্কের কাছে নিরুত্তর ডারউইনকে আপস করতে হয় ভূবিজ্ঞানের দর্শনের সাথে। মুছে ফেলেন তার করা পৃথিবীর বয়েসের হিসাব। তাহলে কি প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব ভুল ছিল? ভুল কে করেছিলেন? ডারউইন না কেলভিন? আমার পিএইচডি এর ডিফেন্স পার্টিতে এক প্রফেসর প্রশ্ন করলেন, পৃথিবীর সব থেকে জনপ্রিয় জিওলজিস্ট কে? সদ্য সদ্য ভূবিজ্ঞানের থিসিস ডিফেন্ড করে এসে এই প্রশ্ন বেশ আকস্মিক। মাথার মধ্যে যে সব নাম ঘুরছে, সেগুলোই বলতে লাগলাম। আর্থার হোমস, আলফ্রেড ওয়াগনার, জে ডি ডানা, হ্যারি হেস, টুজো উইলসন, ড্যান ম্যাকেঞ্জি এদের কথাই মনে হচ্ছিলো। একটা উত্তর ও প্রফেসর এর মনঃপুত হলো না। তিনি উত্তর দিলেন চার্লস ডারউইন। অষ্টাদশ শতকে জিওলজি তখনো জিওলজি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে নি। ন্যাচারাল সাইন্স হিসাবে কলেজে পড়ানো হয়। কেউ কেউ প্রকৃতির বিস্ময়তায় অভিভূত হয়ে দার্শনিক তত্ত্ব দিয়ে থাকেন। জেমস হুটন ন্যাচারাল সায়েন্সে যুগান্তকারী দার্শনিক তত্ত্ব দিলেন, 'uniformitarianism' বা অভিন্নতাবাদ। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, পৃথিবীতে আজকে যা যা ঘটছে, অতীতেও সেই সব প্রাকৃতিক পদ্ধতি কাজ করেছে। বহু বছরের ধীর এবং ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে আজকের পৃথিবী এই রূপ ধারণ করেছে। বর্তমানই অতীতের দরজা (present is the key to the past)। কিন্তু কত পুরোনো এই অতীত, তার হিসাব নেই। হুটনের মতে, পৃথিবীর আদি অন্ত বলে কিছু নেই, পদার্থ বিজ্ঞানের অঙ্ক পৃথিবীর বয়েসকে নির্ধারণ করতে পারবে না, "No vestige of a beginning, no prospect of an end." । উইলিয়াম থম্পসন, বা পরবর্তী কালে লর্ড কেলভিন হিসাবে খ্যাতি লাভ করা পদার্থ বিজ্ঞানী তৎকালীন ভুদার্শনিকদের দর্শনকে ভ্রান্ত মনে করতেন। এই আদি অন্তহীন পৃথিবীর ধারণা অবৈজ্ঞানিক, এবং "reckless drafts on the bank of time". এই বিষয়ে কেলভিনের সাথে ভূবিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু রামসে এর সাথে কিছু কথোপকথন হয়, কেলভিন: "স্কটল্যান্ডের ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য গড়ে উঠতে কত সময় লাগতে পারে বলে মনে হয়?" রামসে: "সময়ের কোনো সীমানা দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ না, আমি পদার্থবিদদের মতো করে ভূতাত্ত্বিক সময়কে বেঁধে দেওয়ার যুক্তিকে বুঝতে পারি না। " এই কথোপকথন হয় ১৮৬৭ সালে। যদিও ততদিনে জিওলজি শৈশব ছেড়ে কৈশোরে পা দিয়েছে, ১৮৩০-১৮৩৩ প্রকাশিত হয়েছে প্রথম জিওলজি বই, চার্লস লিয়েলের, প্রিন্সিপালস অফ জিওলজি (principles of geology)। ১৮৩১ সালে সেই বইটি চলে এসেছে আজ অবধি পৃথিবীর সব থেকে জনপ্রিয় জিওলজিস্ট এর হাতে, চার্লস ডারউইন। ডারউইন তখন ক্যামব্রিজের ছাত্র, তার শিক্ষক (সুপারভাইসর) এডাম স্যাডউইক তৎকালীন বিখ্যাত জিওলজিস্ট। ওয়েলস এর উপকূলে কিছু দিন ভূতত্ত্ব নিয়ে কাজ করার পর ১৮৩১ সালে ডারউইন শুরু করেন দীর্ঘ ৫ বছর ব্যাপী সমুদ্র যাত্রা। বিগেল জাহাজের ক্যাপ্টেন ফিটজ রয়ের থেকে চার্লস লিয়েলের Principles of Geology এর প্রথম খন্ড আসে ডারউইন এর কাছে - শুরু হয় বিজ্ঞানের নতুন অধ্যায়। চার্লস লিয়েল তার বইতে হুটনের অভিন্নতাবাদকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। পাথরের আবহবিকার এবং নগ্নীভবনের (denudation) পদ্ধতি নিয়েও কিছু ধারণা দিয়েছিলেন এই বইতে, যদিও এই সমস্ত প্রাকৃতিক পদ্ধতির সময় কাল নিয়ে লিয়েল কখনোই কথা বলেন নি, তার মতেও সময় ছিল অসীম। ডারউইন ইংল্যান্ডের উপকূলে জিওলজিকাল ফিল্ডওয়ার্ক করার সময় কিছু সাধারণ হিসাব কষেন। ওয়াল্ড (weald) এর উপকূলে একটি ক্ষয়প্রাপ্ত উচ্চভূমির উচ্চতা পরিমাপ করে দেখেন তা প্রায় ৫০০ ফুট। জিওলজিকাল ম্যাপ থেকে ডারউইন ধারণা করেন এই টিলার প্রকৃত উচ্চতা যদি এক সময় প্রায় ১০০০ ফুট হয়, তাহলে সমুদ্রের জলের ধাক্কায় প্রায় ৫০০ ফুট পাথর ক্ষয়ে গেছে। যদি এই ক্ষয়ের পরিমান প্রতি ১০০ বছরে ১ ইঞ্চি হয়, তাহলে সমগ্র ওয়াল্ড অঞ্চলের নগ্নীভবন হতে সময় লেগেছে ৩০৬,৬৬২,৪০০ বছর বা প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বছর। এতো সাধারণ ভাবে হিসাব করে এতো সূক্ষ্ম হিসাব দেওয়া সহজ নয়। প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয় ডারউইনকে। তার বই "অরিজিন" এর দ্বিতীয় সংস্করণে আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়, সময়ের হিসাব অত সূক্ষ্ম হবে না, হয়তো ১-২ সংখ্যার ভুল হতে পারে, যেগুলো ঠিক করে নিতে হবে। যদিও এই ভাবে বললেও, ভূতাত্ত্বিক ভাবে সময়ের হিসাব দেওয়া তখনি সম্ভব হয় নি। ১৮৫৯ সালের ২৪ সে ডিসেম্বর, Origin এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হবার দুইদিন আগে, Saturday Review প্রবল সমলাচনার ঝড় তোলে ডারউইনের হিসাব এবং বিবর্তন তত্ত্বে ওপর, "Enough has been said to show what a pile of unsupported conjecture has been required to sustain this last and ablest attempt to penetrate the mystery of the origin of species." ১৮৬০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওলজিস্ট জন ফিলিপ ডারউইনের হিসাবকে কটাক্ষ করে বলেন, "inconceivable number of 306,662,400 years," এবং "abuse of arithmetic." সমসাময়িক কালে, কেলভিন পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুসারে পৃথিবীর বয়েস হিসাব করছিলেন। তার মতে পৃথিবী একসময় ভীষণ গরম মহাজাগতিক বস্তু ছিল, সেখান থেকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে। তাপপ্রবাহের সূত্র ততদিনে আবিষ্কার করে ফেলেছে জোসেফ ফুরিয়ার। কেলভিন ফুরিয়ারের তাপ পরিবহনের সূত্র ধরে, কিছু সামান্য উষ্ণতার তথ্য জোগাড় করে হিসাব করে ফেললেন পৃথিবীর বয়েস ৯৮ মিলিয়ন বছর। কিছু অনিশ্চয়তাকে ধরলে, এই বয়সের ত্রুটি সীমা হবে ২০-৪০০ মিলিয়ন বছর। Origin এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হবার পর ডারউইন যখন অপেক্ষাকৃত নিশ্চিন্ত, তার কয়েকমাস পরেই কেলভিনের এই হিসাব প্রকাশিত হলো, ১৮৬২ সালের বসন্তে। কেলভিন ইতিমধ্যেই জিওলজিক্যাল দার্শনিক তত্ত্বকে বিশেষ পাত্তা দেন না, সময়ের অসীমতাকে বিশ্বাস করেন না। বিগত এক দশক ধরে ডারউইনের ৩০০ মিলিয়ন বছরের হিসাব তার অন্তর্নিহিত পদার্থবিদকে ক্রমাগত উপহাস করছিলো। অবশেষে পৃথিবীর বয়েস যখন মাত্র ৯৮ মিলিয়ন বছর পাওয়া গেলো তার হিসাব থেকে, ডারউইনের ৩০০ মিলিয়ন বছরের বৃটিশ উপকূলের হিসাব স্রেফ আষাঢ়ে গপ্পের মতো শোনালো। ১৮৬২ এর গবেষণা পত্র ডারউইনের হিসাবকে আক্রমণ করলেন কেলভিন, এবং অভিন্নতাবাদের মতবাদকে আবারো সমালোচনা করলেন। যদিও কেলভিনের এই সমালোচনা জিওলজিস্টদের চোখে বিশেষ পরে নি, ১৮৬৭ সালে ফ্লেইমিং জেনকিন আবার ডারউইনের হিসাব এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। জেনকিনের দাবি অনুযায়ী, কেলভিনের হিসাবে কিছু সামান্য পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু সময় অসীম নয়, এবং এই সীমিত সময় ডারউইনের তত্ত্বের জন্য একেবারেই অপ্রতুল। ১৮৬৮ সালে আবার কেলভিন আক্রমণ করেন ডারউইনের তত্ত্বের ওপর, "It is quite certain that a great mistake has been made-that British popular geology at the present time is in direct opposition to the principles of natural philosophy." ১৮৬৯ সালে লন্ডন জিওলজিকাল সোসাইটি এর প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিযুক্ত হন টমাস হেনরি হাক্সলে। জটিল মনের বিজ্ঞানী। একদিক থেকে যেমন ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের সমর্থক, আবার লিয়েলের অভিন্নতাবাদের বিরোধী। তিনি ছিলেন বিবর্তনবাদী, অর্থাৎ, তার মতে ধীর ক্রমাগত পরিবর্তনের সাথে কখনো কখনো অতিদ্রুত কোনো পরিবর্তন ঘটে (catastrophe)। তাই, কেলভিনের ক্রমাগত আক্রমনের বিরোধিতা করার জন্য প্রথমে কেলভিনের গাণিতিক পদ্ধতির ওপর প্রশ্ন তোলেন হাক্সলে। তার মতে কেলভিনের হিসাব কতগুলো অনিশ্চিত তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে, যাদের হাইপোথিসিস এখনো সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত না। ওপর দিকে, তিনি এও বলেন, জিওলজিস্টদের ও পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে ১০০ মিলিয়ন বছর প্রাকৃতিক পদ্ধতি গুলোর জন্য যথেষ্ট কিনা। আরো বেশ কিছু গবেষণা পত্রে হাক্সলে এবং কেলভিনের মধ্যে বিবাদ চলে, যদিও কেলভিনের অকাট্য গাণিতিক হিসাবকে ফেলে দেবার মতো বিজ্ঞানিক পারদর্শিতা সেই সময় কোনো বিজ্ঞানীর ছিল না। সময়ের অসীমত্ব বা অভিন্নতাবাদ ছিল ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের ভিত্তি। সেখানে পৃথিবীর বয়েস যদি ১০০ -২০০ মিলিয়ন বছরের মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয়, তাহলে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব প্রবল প্রশ্নের মুখে পরে। নিজের তত্ত্বে বিশ্বাসী ডারউইন এই প্রবল গাণিতিক চাপের সামনে পরে অভিন্নতাবাদের সাথে আপস করতে বাধ্য হন। Origin এর পঞ্চম সংস্করণে লেখেন, "With respect to the lapse of time not having been sufficient since our planet was consolidated for the assumed amount of organic change, and this objection, as urged by Sir William Thompson, is probably one of the gravest as yet advanced, I can only say, firstly, that we do not know at what rate species change as measured in years, and secondly, that many philosophers are not yet willing to admit that we know enough of the constitution of the universe and of the interior of our globe to speculate with safety on its past duration." এটাই ছিল ডারউইনের শেষ আত্মপক্ষ সমর্থন, যদিও কেলভিনের অংকের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন নি। পরবর্তীকালে জিওলজিস্টরা ক্রমশ কেলভিনের হিসাব করা পৃথিবীর বয়েসকেই সঠিক বলে মেনে নিতে থাকে। অন্যদিকে পুরাজীববিজ্ঞানীরা গাছের পাতার ক্রমাগত বিবর্তন এবং বিবর্তনের সপক্ষে প্রাকৃতিক নির্বাচনকেই প্রধান কারণ হিসাবে অনুমান করেন। Origin এর সর্বশেষ সংস্করণ প্রকাশিত হবার পর তার ‘সময়’ নিয়ে সমস্ত হিসাবকে বর্জন করেন। পদার্থবিদদের ক্রমাগত প্রশ্নবাণে জর্জরিত এবং ক্লান্ত ডারউইন পৃথিবীর বয়েসের বিতর্ক ছেড়ে দেন পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। ১৮৬৭ সালে, যখন ডারউইন কেলভিনের বিবাদ তুঙ্গে, পোল্যান্ডের ভার্সোভাতে জন্মালেন আর এক কিংবদন্তি বিজ্ঞানী, মারি কুড়ি। ডারউইনের মৃত্যুর দুই দশক পর, হেনরি বেকরেল এবং মারি কুড়ি আবিষ্কৃত তেজস্ক্রিয়তা অবশেষে কেলভিনের হিসাবের ত্রুটি খুঁজে পেলো। তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে উৎপন্ন তাপ শক্তি পৃথিবীর অভন্তরকে এখনো উত্তপ্ত রেখেছে, তার কোনো হিসাব কেলভিনের কাছে ছিল না। তাই কেলভিনের নির্ণীত পৃথিবীর বয়েস ডাহা ভুল এবং পৃথিবীর প্রকৃত বয়েসের কাছে অকিঞ্চিৎকর। তবে, ততদিনে কেলভিনের হিসাবে ভরসা না রেখে জীববিজ্ঞানী এবং পুরাজীববিজ্ঞানীরা ডারউইনের পথেই অনেকটা এগিয়ে গেছেন। References:
0 Comments
Leave a Reply. |
Archives
January 2024
Categories
All
|