ম্যাপ নিয়ে আমার আকর্ষণ ছোট বেলা থেকে। স্কুলে পড়ার সময় চন্ডীচরণ দাসের আধুনিক পৃথিবীর মানচিত্র প্রথমবার হাতে পেলাম। এটাই প্রথম বিশ্বদর্শন। তারপর বহু বছর কেটে গেছে, পৃথিবীর বহু মানচিত্র দেখেছি, কাজের দৌলতে কিছু কিছু জায়গায় নিজে মানচিত্র তৈরী করেছি। পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কন শতাব্দী প্রাচীন প্রয়াস। এখনো পর্যন্ত সংরক্ষিত ম্যাপের মধ্যে সব থেকে প্রাচীন হলো ব্যাবিলনের ইমাগো মুন্ডি। লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের জিম্মায় সংরক্ষিত আছে এই ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ম্যাপ। কিন্তু মানচিত্রে পৃথিবীর ত্রিমাত্রিক ধারণা পাওয়া যায় না। আজ থেকে ২৫০০ বছর আগে পৃথিবীর আকৃতির সম্পর্কে মানুষের বিশেষ ধারণা ছিল না। চিন্তার ধারাবাহিক বিবর্তনে পৃথিবীর আকৃতি সম্পর্কে মানুষ অবহিত হয়েছে। দ্বিমাত্রিক ম্যাপ থেকে এসেছে ত্রিমাত্রিক গ্লোব। কিন্তু কবে কোথায় তৈরী হলো পৃথিবীর প্রথম ত্রিমাত্রিক গঠন? সেই খোঁজ করতে গিয়ে পৌছালাম জার্মানির নুরেনবার্গ শহরে। তবে তার আগে কিছু ভূমিকার প্রয়োজন। জলপথে সাম্রাজ্য বাদের বিস্তার মানুষের ইতিহাসকে বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করেছে। তবে সব থেকে বেশি প্রভাবিত করেছে ভূবিজ্ঞানকে। প্রথম জলপথে অভিযান শুরু হয় ১৫ শতকে, অজানা মহাদেশকে জানতে। দ্বিতীয় জলপথ অভিযান শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে, অজানা মহাসাগরকে জানতে। প্রথম অভিযানে পৃথিবীর ম্যাপ, আকৃতি সম্পর্কে ধারণা তৈরী হয়, দ্বিতীয়বারে তৈরী হয় আধুনিক ভূবিজ্ঞানের তত্ত্ব - প্লেট টেক্টোনিক্স। সেই নিয়ে পরে আলোচনা করা যেতে পারে। আপাতত, ১৫ শতকের প্রথম জলপথ অভিযানের কথা বলা যাক। সেই সময়েই ইউরোপ ধর্মীয় মতবাদকে উপেক্ষা করে পৃথিবীর গতি, আকৃতি ইত্যাদি নিয়ে বিজ্ঞান মহল সরব হয়ে ওঠে। ১৫ শতকের শেষ দিকে ইউরোপের অনেক বিজ্ঞানীরা মনে করতে থাকেন পৃথিবী গোলাকৃতি। বিভিন্ন জলপথ অভিযান এবং বাণিজ্যিক পথের থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সমগ্র পৃথিবীর ম্যাপ তৈরী করার কাজ শুরু হয় এই সময়। তার থেকেও বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল পৃথিবীর ত্রিমাত্রিক আকৃতিকে রূপায়িত করা। ১৪৫৯ সালে জার্মানির নুরেনবার্গ শহরে জন্মগ্রহণ করেন মার্টিন বেহাইম (Martin Behaim)। কিন্তু কর্মসূত্রে বেহাইম জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় পর্তুগালে কাটান। বস্ত্র শিল্পের সাথে যুক্ত থাকার কারণে বেহাইম বেশ কিছু বাণিজ্যিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। ১৪৯০ সালে পর্তুগাল থেকে আবার ফিরে আসেন নুরেনবার্গ। এই সময় নুরেনবার্গ শহরের পরিষদবর্গ এবং মার্টিন বেহাইম পৃথিবীর একটি প্রার্থিব গ্লোব (terrestrial globe) তৈরী করার পরিকল্পনা করেন। মৃৎশিল্পী, কাঠের কারিগর, এবং চিত্র শিল্পী সবাই মিলে ৫১ সেন্টিমিটার ব্যাসের এই গ্লোব তৈরী করেন দুবছর সময় নিয়ে। গ্লোবের উত্তর গোলার্ধ এবং দক্ষিণ গোলার্ধকে যুক্ত করা হয় একটি কাঠের বেড়ি দিয়ে। কাঠের গ্লোবের ওপর পৃথিবীর ম্যাপ আঁকা হয়। বিভিন্ন পর্তুগিজ নটিকাল চার্ট, এবং মধ্যযুগের অভিযাত্রীদের ভ্রমণ কাহিনী (যেমন মার্কো পোলো এবং জন মানডেভিল) থেকে সমগ্র ম্যাপের তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন মার্টিন বেহাইম, Hieronymus Munzer এবং Hartmann Schedel। মার্কো পোলো বর্ণিত ইন্দোচীন সাগরের ১২৭০০ টি দ্বীপপুঞ্জকে (ফিলিপিন্স) এই ম্যাপের মধ্যে রাখেন বেহাইম, যদিও পৃথিবীর পরিধি নিয়ে সঠিক ধারণা না থাকায় এই দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান সঠিক হয় নি। গ্লোবের মধ্যে প্রায় ২০০০ টি জায়গার নাম, ২০০ টি শহরের অবস্থান, স্থানীয় পশু, সামুদ্রিক জীব, এবং সমুদ্রে অবস্থিত জাহাজের বিবরণ পাওয়া যায়। গ্লোব তৈরী হয় ১৪৯২ সালে, যে বছরেই কলম্বাস প্রথম আমেরিকা মহাদেশে পা রাখেন। স্বভাবিক ভাবেই এই গ্লোবের মধ্যে আমেরিকা মহাদেশের অস্তিত্ব ছিল না। অনেকের মতো বেহাইমের ও মনে হতো অতলান্তিক মহাসাগরই পৃথিবীর সব থেকে পশ্চিম প্রান্ত। কেন এই গ্লোব তৈরী হয়েছিল, তার সঠিক কারণ জানা নেই। তবে অনুমান করা যেতে পারে। সেই সময় ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার করার জন্য পৃথিবীর ত্রিমাত্রিক গঠনকে জানা প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল। কেবল মাত্র দ্বিমাত্রিক কাগজ থেকে ভৌগোলিক এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের যৌথ তথ্যকে বোঝার জন্য দুস্কর হয়ে উঠেছিল। এই গ্লোবের বিভিন্ন জায়গায় খনিজ পদার্থ, দামি কাঠ, মুক্ত, মসলা ইত্যাদির স্থান চিহ্নিত করা আছে। সেখান থেকে অনুমান করা যেতে পারে হয়তো বাণিজ্যের কারণেও এই গ্লোবেকে ব্যবহার করার পরিকল্পনা ছিল।
এই বেহাইম গ্লোব (Behaim globe) বা এরদাপ্ফেল (erdapfel) পৃথিবীর সব থেকে পুরানো গ্লোব। এর আগে কোনো গ্লোব তৈরী হয়ে থাকলেও সেগুলোর অস্তিত্ত্ব এখন আর নেই। বর্তমানে এই গ্লোবটি নুরেনবার্গের জার্মান ন্যাশনাল মিউজিয়ামের মধ্যে সংরক্ষিত। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে গ্লোবের ছবিটি তুলে সেই সময়ের পৃথিবীর একটা খসড়া মানচিত্র তৈরী করলাম।
0 Comments
Leave a Reply. |
Archives
January 2024
Categories
All
|