ডাইনোসরদের অবলুপ্তির পর, অর্থাৎ সেই ৬.৫ কোটি বছর আগের সময় থেকে পৃথিবীর বুকে ঘটে গেছে বহু পরিবর্তন। জীবজগতে তো বটেই, ভূতাত্ত্বিক গঠনের দিক থেকে এই বিগত ৬.৫ কোটি বছর এক অভাবনীয় সময় কাল। এই সময়ের মধ্যেই ভারতের মূল ভূখণ্ড বাকি সমস্ত মহাদেশের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রবল গতিতে ইউরেশিয়ার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এই গতিবেগ আজ পর্যন্ত অন্য কোনো টেক্টোনিক পাত অর্জন করতে পারে নি। বছরে প্রায় ২০ সেন্টিমিটার। এই প্রবল গতিবেগের কারণ স্বরূপ তৈরী হলো ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ। ভারত এবং ইউরেশিয়ার মধ্যে। এই ভূতাত্ত্বিক আলোড়নে শুরু হলো হিমালয়ের উত্থান, যা হয়ে উঠলো পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত মালা। কেন হটাৎ বেড়ে গেছিলো ভারতীয় পাতের গতিবেগ, যার পরিণতি এই হিমালয়? এর সাথে সেই প্রাচীন সরীসৃপের ধ্বংসের কারণ কি সংযুক্ত? প্রায় ৬.৫ কোটি বছর আগে আজকের পৃথিবী ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। মানুষ তো ছিলই না, সমগোত্রীয় কেউ ও ছিল না। তখন রাজত্ব করছে বিশালাকায় সরীসৃপরা, বিবর্তনের ইতিহাসে প্রথম দাঁত নখ যুক্ত প্রাণী। তাদের শিকারের হত্যালীলায় সমুদ্র তখন রক্তাক্ত। কিন্তু ৬.৫ কোটি বছর আগে এমন কিছু ঘটনা ঘটতে লাগলো, যাতে পৃথিবীর প্রভুরা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেলো। বলতে গেলে সেই সময়ের প্রায় ৯০% প্রাণিকুল উজাড় হয়ে গেছিলো। বিবর্তনের ইতিহাসে এই রকম ভয়াবহ মৃত্যুমিছিল মাত্র ৫ বার হয়েছে। সর্বশেষ ছিল এই ৬.৫ কোটি বছর আগেকার গণবিলুপ্তি। পঞ্চম গণবিলুপ্তির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে পুরাতত্ত্ববিদরা (paleontologist) বেশকিছু অনুমান করেছেন। অনেকের মতে এই সময় এক বিশাল মহাজাগতিক উল্কাপিন্ড এসে পড়েছিল। পৃথিবীর সাথে এই উল্কাপিণ্ডের ধাক্কায় প্রথমে ভীষণ তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছিল, পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বেড়ে গেছিলো। বিশ্বউষ্ণায়ন হলেই, সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধি পায়। গভীর সমুদ্রের প্রাণীরা জলের চাপের সাথে অভিযোজিত হবার সময় পায় না এবং নষ্ট হয়। এর সাথে উল্কার সাথে সংঘর্ষের ফলে তৈরী হয়েছিল প্রচুর ধূলিকণা। এই ধূলিকণা জমে আকাশে যে মেঘ তৈরী হয়, তাতে সূর্যালোকের প্রবেশ দুরহ হয়। ফলস্বরূপ, আবার পৃথিবীর গড় উষ্ণতা ভয়ঙ্কর কমে যায়, শুরু হয় শৈত্য প্রবাহ এবং সাময়িক বরফযুগ । প্রথমে উষ্ণায়ন এবং পরে শৈত্য প্রবাহের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ প্রাণীরাও সহ্য করতে পারে নি। এদের থেকে যদিও আমরা বিশেষ শিক্ষা নিয়েছি বলে মনে হয় না। যাই হোক, উল্কাপিন্ড ছাড়াও আরো কিছু অনুমান থেকে বলা যায় ঠিক এই সময়ের কাছাকাছি এক বিশাল আগ্নেয়গিরি তৈরী হয়েছিল। ভূতাত্ত্বিক ভাষায় একে বলা হয় supervolcano। বিগত ৬.৫ কোটি বছরে এই মাপের আগ্নেয়গিরি পৃথিবীতে আর তৈরী হয় নি। এই বিশাল আগ্নেয়গিরি বা supervolcano এর বর্তমান অবস্থান ভারত মহাসাগরের কাছে, রিইউনিয়ন নামের একটা দ্বীপে। কিন্তু ৬.৫ কোটি বছর আগে যখন এই অগ্নুৎপাত হয়েছিল, তখন ভারত মহাসাগর ছিল না। তখন আফ্রিকা মহাদেশ আর দক্ষিণ ভারতের ভুখন্ড প্রায় কাছাকাছি ছিল এবং অগ্নুৎপাত ঘটে ভারত ভূখণ্ডের ঠিক নিচে। খুব সম্ভবত এই আগ্নেয়গিরি থেকেই তৈরী হয় মহারাষ্ট্রের দাক্ষিণাত্যের মালভুমি। মহারাষ্ট্র বিভিন্ন জায়গায়, বোম্বে বা পুনের কাছে যে সমস্ত কালো পাথরের পাহাড় দেখা যায়, সমস্তই দাক্ষিণাত্যের অংশ। অনেকের মতে, একটা এই মাপের supervolcano বিস্ফোরণ হলেও বিশ্বব্যাপী জলবায়ু একই ভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, যে ভাবে উল্কার সাথে ধাক্কা লাগলে হতে পারে। প্রথমে বিশ্বউষ্ণায়ন, পরে সাময়িক বরফযুগ। হতে পারে এই যুগ্ম মারণ ধাক্কার ফলেই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণবিলুপ্তি নেমে এসেছিলো ৬.৫ কোটি বছর আগে। এই সেই ৬.৫ কোটি বছর আগের বিতর্কিত আগ্নেয়গিরি, যার সাথে জড়িত আছে পৃথিবীর ইতিহাসের বিশাল অধ্যায়। বিবর্তনকে প্রভাবিত করা ছাড়াও এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান হয়েছে গ্লোবাল টেক্টনিক্সে। বিজ্ঞনীরা মনে করেন, এই আগ্নেয়গিরির মাধ্যমের ভারত এবং আফ্রিকার মধ্যে শেষ বিচ্ছেদ হয়েছিল। খুব সম্ভবত আগ্নেয়গিরির প্রবল ধাক্কার কারণে ভারতীয় পাত প্রচন্ড দ্রুত গতিতে উত্তরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এই সময় ভারতীয় পাতের গতি বেগ দাঁড়ায় বছরে প্রায় ২০ সেন্টিমিটার, যা আজ পর্যন্ত সর্বাধিক পাত গতিবেগ হিসাবে গণ্য করা হয়। সাধারণভাবে, একটি টেক্টোনিক পাত গড়ে ৫ সেন্টিমিটার প্রতি বছর গতিবেগে স্থান পরিবর্তন করে। এই মুহূর্তে সব থেকে দ্রুততম পাতগুলি প্রশান্ত মহাসাগরের অঞ্চলে আছে, যাদের গতিবেগ বছরে প্রায় ১০ সেন্টিমিটারের কাছাকাছি। কিন্তু ভারতীয় পাত বছরে ২০ সেন্টিমিটার গতিবেগে প্রায় ১.৫ - ২ কোটি বছর ধরে এগোতে থাকে উত্তরের দিকে। কেন এই প্রবল গতিবেগ, সে নিয়ে অনেক গবেষণা চলেছে। অতিরিক্ত গতিবেগের প্রথম কারণ হিসাবে দেখানো হয় এই আগ্নেয়গিরির ধাক্কা। একে বলে plume push force (চিত্র ১)। কিন্তু এই বলের দ্বারা পরিচালিত হলেও এই দ্রুত গতিবেগ কয়েক লক্ষ বছরের বেশি স্থায়ী হওয়া উচিত নয়। ২০০৭ সাথে Nature পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় একটি হাইপোথিসিস- রিউনিয়নের আগ্নেয়গিরির তাপপ্রবাহে ভারতীয় পাতের অনেকাংশ ধ্বংস হয় এবং অবশেষে একটি পাতলা পাতে রূপান্তরিত হয়। সাধারণত মহাদেশীয় পাত গুলো মহাসাগরীয় পাতের তুলনায় অনেক পুরু হয়। মহাসাগরীয় পাতের পুরুত্ব ১০০ কিলোমিটারে কাছাকাছি, কিন্তু মহাসাগরীয় পাতগুলো প্রায় ২৫০ - ৩০০ কিলোমিটারের মতো পুরু হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আগ্নেয়গিরির কারণে ভারতের মহাদেশীয় পাত পাতলা হয়ে ১০০ কিলোমিটারের মতো হয়ে গেছে। এই পাতলা পাতের কারণে ভারতভূখন্ড ১.৫ - ২ কোটি বছর ধরে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলতে থাকে। হাইপোথিসিস দেওয়া হলেও, পরীক্ষা করে কখনো দেখা হয়নি যে রিইউনিয়ন সত্যিই ভারতের মহাদেশীয় পাতকে ক্ষয় করে পাতলা করে দিতে পারে কিনা। আমাদের একটি নতুন গবেষণায় এই হাইপোথেসিসকে পরীক্ষা করার জন্য কিছু গাণিতিক মডেল তৈরী করি। মডেলগুলিতে প্রথমে ভারতের মহাদেশীয় পাতকে ৩০০ কিলোমিটার পুরু করা হয়। ৬.৫ কোটি বছর অতিক্রান্ত হবার পরে দেখা যায় যে পাতের অনেকটা অংশ আগ্নেয়গিরির দ্বারা ক্ষয় প্রাপ্ত হয়েছে। আমাদের মডেলে দেখেছি যে ভারতীয় পাত সর্বাধিক প্রায় ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত ক্ষয়ে যেতে পারে। কিন্তু, আমাদের হিসাব দেখায় যে এই ক্ষয় প্রাপ্তি ৬.৫ কোটি বছর আগে হয় নি। অর্থাৎ ৬.৫ কোটি বছর আগে, যখন পাতের গতিবেগ সর্বাধিক হয়েছিল, তখন কিন্তু ভারতীয় পাত পাতলা ছিল না। তাহলে পাতলা পাতের কারণে গতিবৃদ্ধির হাইপোথেসিসটি সম্পূর্ণ সঠিক হচ্ছে না। অন্য কি কারণ হতে পারে? আমাদের সাম্প্রতিক মডেলে আরো একটি জিনিস দেখতে পাই, যা কিনা পাতের গতিবেগ বৃদ্ধির সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। রিইউনিয়নের মতো আগ্নেয়গিরি পৃথিবীর অনেক গভীর থেকে উঠে আসে (হয়তো প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার গভীরতার থেকে)। এদের বলা হয় mantle plume (চিত্র ১)। প্লিউম এর আকার অনেকটা মাশরুমের মতো। একটা বড় গোল মাথা, আর একটা একটা লম্বা লেজের অংশ। প্রথমে বড় মাথাটা ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে আসে। তৈরী করে বিশাল আগ্নেয়শিলার অঞ্চল (large igneous province)। রিইউনিয়নের ক্ষেত্রে এই বিশাল আগ্নেয়শিলার অঞ্চল সম্ভবত দাক্ষিণ্যতের মালভুমি, যা ব্যাসল্ট জাতীয় আগ্নেয়শিলা দিয়ে তৈরী। আর প্লিউমের লেজের অংশ থেকে তৈরী হতে থাকে ছোট ছোট সামুদ্রিক দ্বীপপুঞ্জ। আফ্রিকার মাদাগাস্কার থেকে ভারতের দিকে এগোলে এইরকম অসংখ্য দ্বীপপুঞ্জ দেখা যাবে, যেমন সেইচেলস, মালদ্বীপ, লক্ষদ্বীপ - এই সমস্তই খুব সম্ভবত রিইউনিয়ন প্লিউমের লেজের অংশ থেকে তৈরী হয়েছে। এর থেকে অনুমান করা হয়, রিইউনিয়নের প্রভাব কিন্তু শুধু ৬.৫ কোটি বছর আগের একটা আগ্নেয়গিরির মধ্যেই শেষ হয়ে যায় নি, কিন্তু এর অস্তিত্ব গোটা ভারতমহাসাগর জুড়েই রয়েছে। রিইউনিয়ন প্লিউমের সমস্ত তাপ পরিবাহিতা এবং সান্দ্রতা হিসাব করে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই প্লিউমের তাপে ভারতীয় পাত শুধু মাত্র পাতলা হয়ে যায় নি, তা ভীষণ ভাবে নরম হয়ে পড়েছে। এর ফলে ভারতীয় পাত এবং তার নিচে অবস্থিত গুরুমন্ডলের মধ্যে ঘর্ষণ বল কমে গেছে। এই কারণেই সম্ভবত, plume push force এর প্রভাবে ভারতীয় পাত দীর্ঘদিন ধরে এই গতিবেগ বজায় রাখতে পেরেছে। সহজ ভাবে ভাবতে গেলে, একটা বাক্সকে যদি মেঝের ওপর একবার ধাক্কা দি, তাহলে কিছু তা এগিয়ে থেমে যাবে (চিত্র ২)। কারণ মেঝে আর বাক্সের মধ্যে ঘর্ষণ বল কাজ করবে। কিন্তু বাক্সের তলায় তেল দিয়ে অথবা ৪ তে চাকা লাগিয়ে ধাক্কা দি, সেই একবার ধাক্কার প্রভাবেই বাক্সটি অনেক বেশি দূর পর্যন্ত দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবে। ভারতীয় পাত এখানে এই রকম একটি কল্পিত বাক্স, আর তার নিচে অবস্থিত গুরুমন্ডল এই রকম মেঝে। রিইউনিয়ন প্লিউম এই দুই এর মধ্যে ঘর্ষণ বল কমিয়ে দিতেই ভারতীয় পাত দীর্ঘ সময় ধরে দ্রুত গতিতে এগোতে লাগলো - যতক্ষণ না পর্যন্ত উত্তরের ইউরেশিয়ার সাথে ধাক্কা লাগে। বিজ্ঞান তো জানা গেলো। কিন্তু কি লাভ আমাদের এই জেনে? ভারতীয় পাতের গতিবেগ বেড়েছিল কিনা, কেনই বা বেড়েছিল? তাই নিরস বিজ্ঞান ছেড়ে আবার একটু বেরোনো যাক। আমরা জানি হিমালয় পৃথিবীর সর্বোচ্চ পাহাড়। এর ১৪ টা শৃঙ্গ আছে ৮০০০ মিটারের ওপর। হিমালয়ের বাইরে সর্বোচ্চ পাহাড় দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ। আন্দিজের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আকংকাগুয়া এর অবস্থান হিমালয়ের প্রথম ২০০ টা শৃঙ্গের মধ্যেও হবে না। তাহলে কি কারণে হিমালয় এতো ভয়ঙ্কর উচ্চতা লাভ করলো? সম্ভবত, ভারতীয় পাতের এই অস্বাভাবিক গতিবেগের কারণে দুই পাতের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়েছিল, সেই ব্যাপক ধাক্কা পৃথিবীর ৬.৫ কোটি বছরের ইতিহাসে কখনোই দেখা যায় নি। এই ধাক্কা থেকে যে জটিল টেক্টোনিক্স প্রদেশ তৈরী করেছে তার থেকেই উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় বল পেয়েছে। আর হিমালয়ের জন্য ভারতের জলবায়ু, কৃষিকাজ, ভূমিরূপ কি ভাবে প্রভাবিত হয়েছে, এসব কথা ছোট বেলায় স্কুল থেকে পড়ে এসেছি, তাই আর বিশ্লেষণ করলাম না। হতে পারে, রিউনিয়নের এই plume push force এবং তার তাপের প্রভাবে ভারতীয় পাতের গতি বৃদ্ধি না পেলে আজকের হিমালয় এই রকম উচ্চতায় যেত না। সেই আদিমের ডাইনোর যুগের কোন এক আগ্নেয়গিরি, আজও আমাদের জীবনকে বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করে চলেছে, আমাদের বিবর্তন থেকে আজকের দিনের খাওয়া ডাল ভাত। References:
2 Comments
Ayan sarkar
12/24/2021 07:49:33 pm
Excellent information as well as writing.
Reply
Jyotirmoy
12/25/2021 01:08:18 pm
Thank you for reading and the article.
Reply
Leave a Reply. |
Archives
January 2024
Categories
All
|