বোম্বে থেকে জাহাজে চেপে দক্ষিণ আফ্রিকা বা আন্টার্কটিকা যাওয়া আজকাল অনেক সহজ, যদি পকেটে পয়সা থাকে। বৈজ্ঞানিকরা অবশ্য গবেষণার সূত্রে অনেক সময়েই যাত্রা পথে পাড়ি দেন। এই পথের প্রাণ প্রাচুর্য যেমন প্রাণিবিদদের আকর্ষণ করে, তেমনি ভূবিজ্ঞানীদের কাছে এই অঞ্চল প্রাকৃতিক গবেষণাগার। দাক্ষিণাত্যের মালভুমি, ডাইনোসোরদের অবলুপ্তির ইতিহাস, ভারতীয় পাতের উত্তরমুখী অভিযান এবং সর্বোপরি হিমালয়ের সৃষ্টি - সমস্ত রহস্যই লুকিয়ে আছে এই বোম্বে থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে অবস্থিত ভারত মহাসাগরের জলরাশির নিচে। কিন্তু এই অঞ্চলের জলরাশিও কম রহস্যময়ী নয়। বোম্বে থেকে দক্ষিণে পাড়ি দিতেই সমুদ্রের জলতল পারিপার্শ্বিক জলতলের থেকে ক্রমশ নিচে নামতে থাকে। ভারত মহাসাগরের মাঝামাঝি জায়গায় জলতল প্রায় ১০০ মিটার নিচে যায়। ঠিক একটা গর্তের মতো। যদি স্থলভাগ হতো, তাহলে এটা কোনো বিস্ময়কর ব্যাপারই নয়। ডাঙায় একটা ১০০ মিটার গভীর গর্ত থাকতেই পারে। কিন্তু জলের মধ্যে গর্ত কি করে হয়? জলের মধ্যে যে কেন গর্ত হতে পারে না, তার কারণটা অনেকেই জানে। সেটা হলো জলের সমোচ্চশীলতা ধর্ম। একটা পাত্রে (যেকোনো পাত্র, গ্লাস,ঘটি, বালতি, টব) জল রাখলে জলের উপরিতল একই উচ্চতায় থাকবে। বাড়ির সামনে পুকুর, দীঘি, নদীতেও একই জিনিস দেখি। হাওয়ার জন্য কোনো কোনো সময়ে জলের ঢেউয়ের উচ্চতা একটু পরিবর্তন হয়, কিন্তু সেগুলো ক্ষনিকের জন্য এবং সমুদ্রতলের গড় উচ্চতাকে প্রভাবিত করে না। দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থায়ীভাবে জলতলের উচ্চতা কখনোই পরিবর্তিত হয় না। তাহলে কি হচ্ছে ভারত মহাসাগরের নিচে? এর কারণ বুঝতে গেলে প্রথমে পৃথিবীর আকৃতি সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকা দরকার। সহজ করে বোঝার জন্য পৃথিবীকে গোল করে আঁকলেও, পৃথিবীর আসল চেহারা কিন্তু আলুর মতো। উঁচু-নিচু, এবারো খেবড়ো। পৃথিবীর এই আকৃতির পুরোটা শুধু মাত্র বাইরের খোলসের (যাকে বলে crust বা ভূত্বক) নয়। পৃথিবীর গভীরে ঘনত্ব কিভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তার ওপরেও নির্ভর করে পৃথিবীর আকৃতির বহিঃপ্রকাশ। পৃথিবীর গভীরের ঘনত্ব কি ভাবে বাইরের রূপকে প্রভাবিত করে, সেটা জানার জন্য ভূবিজ্ঞানীরা পৃথিবীর কয়েকটি কাল্পনিক তল হিসাব করে। এর মধ্যে একটা হলো রেফারেন্স এলিপসোয়েড (Reference ellipsoid), অর্থাৎ পৃথিবীর আকৃতিকে যদি একটি পারফেক্ট উপবৃত্ত হিসাবে কল্পনা করা হয়, তাকে বলে Reference ellipsoid। ওপরের ছবিতে নীল রঙের রেখা দিয়ে reference ellipsoid কে দেখানো হয়েছে। এরকম আরেকটি তল হলো Geoid (জিওয়েড)। পৃথিবীতে যদি কোনো স্থলভাগ না থাকে, কোনো বায়ুপ্রবাহ না থাকে, কেবল মাত্র পৃথিবীর গতি এবং মাধ্যাকর্ষণের জন্য একটি তল কল্পনা করা যায়, তাহলে তাদেরকে বলে equipotential surface। এই surface গুলো অদ্ভুদ, কারণ এখানে যতই কাজ করা হোক, গাণিতিক ভাবে net work done শুন্য হবে। পৃথিবীর আকৃতি নির্ধারণ করার জন্য এরকম অনেক equipotential surface কল্পনা করা যাবে, কিন্তু যে equipotential surface টি সমুদ্র পৃষ্ঠের সাথে সমান হবে, তাকে বলে geoid। প্রথম ছবিতে লাল রঙের দাগ দিয়ে geoid surface কে দেখানো হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে geoid সমুদ্রপৃষ্ঠের ওঠা নামকেই নির্দেশ করে। এর একটা ব্যবহারিক দিক আছে, যা আমরা প্রতিনিয়তই কাজে লাগাই। দার্জিলিং বেড়াতে গেলে বলি, আমরা এখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০৪২ মিটার উঁচুতে আছে। কিন্তু দার্জিলিঙের ধারে কাছে কোথাও সমুদ্র নেই। তাহলে এই ২০৪২ মিটারের হিসাবটা আসে কথা থেকে? আসলে দার্জিলিং (বা পৃথিবীর যেকোনো স্থলভাগ) এর নিচে একটা কাল্পনিক geoid থাকে, যার সাপেক্ষে কোনো স্থানের উচ্চতা পরিমাপ করা হয়। geoid এবং reference ellipsoid এর মধ্যে উচ্চতার পার্থক্যকে বলে geoid anomaly। যদি geoid এর উচ্চতা reference ellipsoid এর উচ্চতার থেকে কম হয়, তাকে বলে negative geoid anomaly। সমুদ্রপৃষ্ঠে negative geoid anomaly তৈরী হলে, সেই খানে জলতল পারিপার্শ্বিকের থেকে নেমে যায়। স্যাটেলাইট ডাটা এর সাহায্যে geoid anomaly কে নিখুঁত ভাবে বোঝা যায়। geoid anomaly জানা গেলেই, সমুদ্রতলের ওঠা নামা পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাবে। এরকম বিভিন্ন ডাটা থেকে তৈরী করা একটা ত্রিমাত্রিক ছবি যদি দেখি,তাহলে পরিষ্কার দেখা যায় যে ভারত মহাসাগরের মধ্যে, শ্রীলংকার দক্ষিণে, geoid anomaly সর্বনিম্ন হয়, প্রায় ১০৬ মিটারের কাছাকাছি। জিওফিজিক্সের ভাষায় এই অঞ্চলকে বলে Indian Ocean Gravity Low (IOGL)। এই জায়গায় সমুদ্রের জল প্রায় ১০০ মিটার নিচে নেমে গেছে। জলের মধ্যে কি করে তৈরী হলো এই geoid anomaly? পরবর্তী পর্বে IOGL এর তৈরির সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করবো।
0 Comments
Leave a Reply. |
Archives
January 2024
Categories
All
|